ড. মোঃ আবদুছ ছালাম:বাংলাদেশের কৃষি যখন জীবন জীবিকার কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে ধাপে ধাপে এগুচ্ছিল, তখনই বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে দেখা দিল কোভিড-১৯। স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখে ছিলেন এ দেশের সোনার মাটিতে সোনার ফসল জন্মানোর। বঙ্গবন্ধু কৃষিক্ষেত্রে গতিশীলতা আনয়নের জন্য গ্রহণ করেছিলেন স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা। তিনিই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন এবং কৃষিতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ প্রদান করেছিলেন।
আমাদের অর্থনীতি এবং জীবন জীবিকা মূলত: কৃষি নির্ভর। উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠির সমৃদ্ধির জন্য কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের জিডিপিতে কৃষিখাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, শ্রম শক্তির প্রায় ৪০% কর্মসংস্থান যোগান এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাঁচামাল সরবরাহ করছে। গ্রামীণ দারিদ্রতা হ্রাসকরণ এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। যদিও বাংলাদেশের কৃষি স্থানীয় এবং বৈশ্বিক নানাবিধ প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে এবং অনুসরণীয় হচ্ছে, তথাপি করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে সৃষ্ট সামগ্রিক পরিস্থিতিতে কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য উদ্যোগ গ্রহন প্রয়োজন।
ক্ষুধা ও দারিদ্রতা জয়ের লড়াইয়ের সম্মূখীন দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ঘনবসতিপূর্ণ কৃষি প্রধান বাংলাদেশ। কোভিড-১৯ মহামারিটি দেশের খাদ্য উৎপাদন, চাহিদা, বিপণন, এবং কৃষকের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণসহ কৃষির সামগ্রিক বিষয়গুলোকে সরাসরি প্রভাবিত করেছে। একসাথে পুরো খাদ্য সরবরাহ চেইনকে (Supply Chain) ব্যাহত করার মাধ্যমে কোভিড-১৯ দেশের দরিদ্র ও দুর্বলদের (Vulnerable) স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে আরো অধিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। অস্বচ্ছল জনগোষ্ঠীর খাদ্যে প্রবেশিধারকে আশংকাজনকভাবে সীমিত করেছে। শ্রমের অভাব খাদ্য সরবরাহের শৃঙ্খলকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। জীবন-জীবিকা ও আয় হ্রাস এবং পুষ্টিকর খাবারের স্বল্প প্রাপ্যতা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরো দুর্বল করে দিচ্ছে। করোনা প্রাদুর্ভাবে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়া মানে বাঁচা-মরার আর এক মহাসংকটের মুখোমুখি হওয়া। কাজেই কৃষিতে করোনার প্রভাব সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা পূর্বক পরিত্রাণ বা উত্তরণের জন্য করণীয় নির্ধারণ করা বিশেষ প্রয়োজন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন উন্নত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং প্রয়োগ করে দ্বিগুন খাদ্য শস্য উৎপাদন করার। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশ আজ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৪ গুণের বেশি। কৃষি শিক্ষা, গবেষণা এবং সম্প্রসারণের যে ভিত্তি বঙ্গবন্ধু গড়েছিলেন এবং যে সকল পলিসি গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলো বাস্তবায়ন এবং শক্তিশালী করার মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনায় ও মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর মেধা ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন নেতৃত্বে আজ কৃষি ক্ষেত্রে উত্তোরোত্তর সাফল্য অর্জিত হচ্ছে। কৃষিতে অর্জিত এ সাফল্যকে ধরে রাখতে সৃষ্ট চ্যালঞ্জেসমূহ মোকাবিলা, সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি-২০১৮’ বাস্তবায়ন এবং ২০৩০ সলের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনসহ ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠির খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য নিন্মলিখিত কৌশলগত বিষয়াবলী বিবেচনাপূর্বক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরী।
টেকসই খাদ্য উৎপাদন এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টিঃ
বিদ্যমান কৃষি ব্যবস্থাকে বিবেচনা পূর্বক উচ্চ ফলন ও লাভজনক লাগসই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও অবলম্বনের মাধ্যমে কৃষিতে অর্জিত সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষাকল্পে টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বালাইনাশক ব্যবহারের কারণে পরিবেশের অবক্ষয় থেকে রক্ষার জন্য সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি জোরদার ও সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে ফসলের অবশিষ্টাংশ, জৈব সার এবং পশুবর্জ্য ব্যবহারের মাধ্যমে জৈব চাষকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। টেকসই কৃষি ব্যবস্থায় চাষাবাদের সাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত অন্যান্য দিকগুলোর মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা প্রয়োজন। টেকসই কৃষি এমনভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে যেন তা সম্পদ সাশ্রয়ী, সামাজিকভাবে সহায়ক, বাণিজ্যিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ বান্ধব হয়।
কৃষি গবেষণা জোরদারকরণঃ
জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম (এনএআরএস)-এর আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ চাহিদা অনুযায়ী কৃষি প্রযুক্তি (ফসলের জাত ও ব্যবস্থাপনা) ও তত্ত্ব উদ্ভাবন করে থাকে। এছাড়াও প্রযুক্তির উপযোগিতা (Validation) যাচাইসহ উদ্ভাবিত প্রযুক্তির অধিকতর উন্নতি সাধন করে থাকে। দরিদ্র ও অসহায় জনগোষ্ঠী অধ্যশিত প্রাকৃতিকভাবে সমস্যাসংকুল এলাকার (যেমন: পাহাড়, উপকূলীয়, হাওর ও বরেন্দ্র এলাকাসমূহ) ঝুঁকি অগ্রাধিকারের ভিত্তেতে মোকাবেলা করা জরুরি। এই ধরণের উদ্যোগ বিদ্যমান প্রযুক্তিগুলোকে উন্নত ও উপযোগী করবে, ফলন পার্থক্য কমাবে, বৈচিত্র্য বাড়াবে, টেকসই প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, কৃষিকাজে বৃষ্টি ও নদীর পানির ব্যবহার, রোগ ও বালাই নিয়ন্ত্রণ, উচ্চমূল্য ফসলের জাত উন্নয়ন ও ফসল সংগ্রহত্তোর প্রযুক্তির জন্য এসকল জাতের উপযোগী কৃষি উপকরণ উদ্ভাবন, যান্ত্রিকীকরণ ইত্যাদি নিশ্চিত করবে। এ ধরনের গবেষণা প্রতিকূল পরিবেশ সহিষ্ণু, স্বল্পমেয়াদি শস্যজাত উন্নয়ন ও প্রচলনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করবে। প্যাকেজিং, ফসল উত্তোলন, পরিপক্কতা সূচক, বাজারের কার্যকারিতা, খাদ্য প্রক্রিয়াজতকরণের ওপর গবেষণা জোরাদর করা প্রয়োজন। অন্যান্য সমসাময়িক বিষয়াবলীর গবেষণার ক্ষেত্রে আইপিএম, মাঠ পর্যায়ে পানি ব্যবস্থাপনা, জীব প্রযুক্তি, জৈব নিরাপত্তা ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর বিশেষ জোর দেয়া দরকার। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত গবেষণা ক্ষেত্র হিসেবে হাইব্রিড, ভালো বীজ, ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, পাট, সমুদ্রশৈবাল, তৈলবীজ, সবজি, ফলমূল, তুলা, আখ, এবং বিভিন্ন ঘাতসহিষ্ণু ও জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী জাতের উন্নয়ন, মাঠ ফসল, শাক-সবজি, ফলমূল, ফুলের জন্য প্রান্তিক ও প্রতিকূল পরিবেশ ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উন্নত ব্যবস্থাপনা, উত্তম কৃষি চর্চা; ফসল সংগ্রহত্তোর ব্যবস্থাপনা, কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও মূল্য সংযোজন, ফসলের রোগবালাই ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা (এনআরএম), জীববৈচিত্র্য, কৃষিতে জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, খামার যান্ত্রিকীকরণ, ফলন পার্থক্য হ্রাস, শস্য বহুমুখীকরণ, আর্থসামাজিক নীতি, কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষিপণ্য ও উপকরণে ভর্তুকি ইত্যাদি বিষয়ক গবেষণা জোরদার করা প্রয়োজন।
মানসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদনের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারঃ
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, বর্ধিষ্ণু আয়ু, বাড়তি চাহিদা, বৃহত্তর বাণিজ্য ও রপ্তানির বিপরীতে বাৎসরিক ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। লাগসই সার ও পানি ব্যবস্থাপনার সম্প্রসারণ, রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের উন্নত প্রযুক্তি এবং স্বল্পমেয়াদি ও প্রতিকুল পরিবেশ উপযোগী জাত ব্যবহার করে প্রতি বছর অধিক ফসল উৎপাদন করা যেতে পারে। জাত উন্নয়ন, ফসল ব্যবস্থাপনা, ফসল সংগ্রহত্তোর ব্যবস্থাপনা, মূল্য সংযোজন, বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনে স্থিতিশীলতা ও নির্ভরশীলতা অর্জন করা যায়। উচ্চমূল্যের ফসল ফলানো হবে যেগুলো স্বল্প পুষ্টিসম্পন্ন মাটিতে অধিক উৎপাদনশীল হতে পারে। উৎপাদনশীলতা নিয়ন্ত্রণকারি মৌলিক ও শারীরতাত্ত্বিক বিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন।
টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে সুষম ও টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা আবশ্যক। স্বল্প উপকরণ সহায়তার মাধ্যমে অধিকতর খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। নতুন উদ্ভাবিত বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন-তথ্য প্রযুক্তি, ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা (জিআইএস), ক্রপ জোনিং, জীব প্রযুক্তি, লেজার প্রযুক্তি, দক্ষ ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থা, মাটি পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক পুষ্টি উপাদানের জন্য এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট পুষ্টি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার প্রতি অধিক মনোযোগ দিতে হবে। কৃষি উৎপাদন পরিকল্পনা এবং বালাই ব্যবস্থাপনা কৌশলের জন্য কৃষি আবহাওয়া তথ্যকে অধিকতর কাজে লাগাতে হবে। রিমোট সেন্সিং টুল ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ও ফসলের ক্ষতির সঠিক প্রক্ষেপণ বিষয়ক গবেষণা জোরদার করা প্রয়োজন।
খামার যান্ত্রিকীকরণঃ
খামারে যান্ত্রিকীকরণ উপকরণ ও সম্পদ ব্যবহার দক্ষতাকে উন্নত করে। কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার ফসল ও ফসল উত্তোলন-পরবর্তী ক্ষতি কমায়, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করে, খামার শ্রমিকের খাটুনি কমায়, উচ্চ মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে দ্রুততম ও সময়ানুযায়ী পরিচালনা নিশ্চিত করে। যান্ত্রিকীকরণ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, মানসম্মত উৎপাদনের মাধ্যমে উন্নত জীবিকা ও পেশা হিসেবে কৃষির সম্মান বৃদ্ধি করে এবং সার্বিক আয় বৃদ্ধি করে। ফসল উৎপাদনকে নিবিড়তর ও বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সেচসহ খামার যান্ত্রিকীকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। চাহিদাভিত্তিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহারকে জনপ্রিয় করতে এবং কৃষি উৎপাদনে সৌর শক্তিসহ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারকে সহজতর করতে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। বর্তমানে প্রায় ৯০ ভাগ জমি চাষ করা হয় পাওয়ার টিলার এবং ট্রাক্টরের মাধ্যমে। চারা রোপন/বপন এবং ফসল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ট্রান্সপ্ল্যান্টার এবং হার্ভেস্টার ব্যবহার অপ্রতুল। সাম্প্রতিক সময়ে হাওড়ের বোরো ধান সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমরা খামার যান্ত্রিকীকরণের সুফল ভোগ করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় মাননীয় কৃষি মন্ত্রী কর্তৃক হাওড় অঞ্চলের বোরো ধান কাটার জন্য প্রায় ৪০০ টি কম্বাইন হার্ভেস্টার এবং রিপার বরাদ্দের ফলে খুব স্বল্প সময়ে কোন রকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই হাওড় অঞ্চলের ধান কাটা সম্ভব হয়েছে। হাওড় অঞ্চলের নির্বিঘ্ন এ উৎপাদন দূর্যোগ মোকাবেলায় কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক হয়েছে।
বর্তমানে কৃষি ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে শ্রমিক সংকট। এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতি উপজেলায় আবাদি জমির ভিত্তিতে কমপক্ষে ১০টি করে ট্রান্সপ্লান্টার এবং কম্বাইন হার্ভেস্টার ৮০% ভর্তূকির মাধ্যমে গঠিত Common Interest Group (CIG) কে বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে।
কৃষি উপকরণ-বীজ ও সার নিশ্চিতকরণঃ
বর্তমানে বিএডিসির বীজ খামারগুলোতে ধান, গম, মশলা, ভুট্টা, শাকসবজি, ডাল, তৈলবীজ, আলু, পাট ইত্যাদি উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এছাড়াও, চুক্তি ভিত্তিতে কৃষকেরা বীজ উৎপাদন করে থাকে। উৎপাদনের সকল স্তরে বীজের গুনগতমান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন। বপনের জন্য উন্নত বীজ ও উৎপাদনের সকল স্তরে বপনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থাসমূহ বিএডিসি এবং ডিএই-র উদ্যানতত্ত্ব কেন্দ্রগুলোকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। হাইব্রিড বীজ উৎপাদন, বিপণন ও উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সুবিধা ও অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নে গুরুত্বারোপ করা দরকার। বীজ উৎপাদন, পরীক্ষণ, সংরক্ষণ ও ফসল সংগ্রহত্তোর ব্যবস্থাপনায় উন্নততর পদ্ধতি অবলম্বনের বিষয়ে কৃষকদেরকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান জোরদার করা প্রয়োজন।
ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বর্তমানে আধুনিক কৃষির প্রসার ও আবাদি জমির নিবিড়তম ব্যবহারের ফলে সারের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। টেকসই ফসল উৎপাদনে যথাসময়ে সারের সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। ভর্তুকির পরিমাণ ভারসাম্যপূর্ণ করায় সারের পরিমিত ব্যবহার উৎসাহিত হয়েছে এবং এ থেকে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। তাই জমির উর্বরতা বজায় রাখতে পরিমিত রাসায়নিক সার ও জৈব সার ব্যবহারে বাস্তবমুখী পদ্ধতি গ্রহণে কৃষকদেরকে অব্যাহতভাবে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
শস্য বহুমুখীকরণ ও উচ্চমূল্যের ফসলের প্রসারঃ
শস্য বহুমুখীকরণ সফল হলে খাদ্যশস্য ফলানোর রীতি থেকে বেরিয়ে এসে খাদ্যশস্য-বহির্ভূত উচ্চমূল্য ফসল চাষাবাদের প্রসার ঘটবে। বহুমুখীকরণের মাধ্যমে খাদ্যাভাস ধীরে ধীরে পরিবর্তিত ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জিত হতে পারে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির জন্য পাট, সুগন্ধিযুক্ত চাল ও বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফুল চাষ, বিপণন ও মূল্য শৃঙ্খলের সাথে উন্নত সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কৃষিবৈচিত্র্য অর্জন করা সম্ভব।
ক্রপ জোনিং ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনাঃ
খাদ্য উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার ও সংরক্ষণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদন কার্যক্রমে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে ভূমি ব্যবহারের সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কোন এলাকায় কোন ফসল উৎপাদন হবে তা ক্রপ জোনিং-এর ওপর ভিত্তি করে নির্ধারন করা দরকার।
উত্তম কৃষি চর্চা (জিএপি) প্রচলনঃ
উত্তম কৃষি চর্চা (জিএপি) নীতিমালা-২০২০এর চূড়ান্ত খসড়া কৃষি মন্ত্রনালয়ে দাখিল করা হয়েছে যা খুব শীঘ্রই গেজেট আকারে প্রকাশিত হবে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনসহ রপ্তানি বানিজ্য প্রসারের জন্য উত্তম কৃষিচর্চা (জিএপি) প্রচলন অত্যাবশ্যক। উত্তম কৃষিচর্চা (জিএপি) প্রচলনে গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন।
উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণঃ
উৎপাদিত কৃষিপণ্য যেমন: বিভিন্ন ধরণের সবজি, ফল এবং ফুল স্বল্প সময়ের জন্য সংরক্ষণের তেমন সচল ভৌত অবকাঠামো নেই বললেই চলে। মৌসুমে উৎপাদিত শাকসবজি, ফল ও ফুলে প্রায়সই বাজার সয়লাব হয়ে যায়, ফলে কৃষক ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত ভৌত অবকাঠামোগুলো সচল করে সংশ্লিষ্টদেরকে ব্যবহারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করা যেতে পারে।
কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের উন্নতি সাধনঃ
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক শ্রমঘন কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণসহ খাদ্য শিল্পের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে কৃষিতে। আমাদের দেশে বিভিন্ন পচনশীল কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে মৌসুমে উদ্বৃত্ত দেখা যায়। কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধাগুলোর উন্নয়ন হলে ফসল সংগ্রহত্তোর ক্ষতি হ্রাস ও কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের ক্রমশ উন্নয়ন ঘটছে। হ্যান্ডলিং, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও কৃষিপণ্য মোড়কজাতকরণে প্রয়োগকৃত প্রযুক্তি দেশজ ও রপ্তানি উপযোগী হওয়া উচিত। ফসল সংগ্রহত্তোর ব্যবস্থাপনা যেমন-প্যাকেজিং ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ সংক্রান্ত প্রযুক্তিগত উন্নয়নে গবেষণা জোরদার করা প্রয়োজন। বেসরকারি খাতকে প্রক্রিয়াজাতকৃত ফলমূল ও শাকসবজি দেশের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানিতেও উৎসাহিত করতে হবে।
মূল্য শৃংখলের উন্নয়ন (Value Chain Development):
খামার থেকে ভোক্তা পর্যায়ে কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করার জন্য কৃষি বিপণনের সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন। কৃষি মন্ত্রণালয় এর আওতাধীন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে নির্বাচিত শাকসবজি ও ফলমূলগুলোর মূল্য শৃঙ্খল উন্নয়নে সহায়তা দিচ্ছে। মান নিয়ন্ত্রণ ও ফাইটো-স্যানিটারি বিষয়ক চাহিদা পূরণে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি এ অধিদপ্তরের সক্ষমতার উন্নয়ন প্রয়োজন। কৃষির মূল্য শৃঙ্খলে বেসরকারি খাত অংশগ্রহণের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ মূল্য শৃঙ্খল উন্নয়নে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা সেবা প্রদান ব্যবস্থাও শক্তিশালী করা উচিত।
কৃষি পণ্য পরিবহনঃ
কৃষি পণ্য পরিবহনে সহায়তা প্রদান প্রয়োজন। পণ্য পরিবহনে ভর্তূকি এবং টোল ফ্রি পরিবহন ব্যবস্থা প্রচলন করে কৃষকদেরকে উৎপাদনে উৎসাহিত করা যেতে পারে। কৃষিপণ্য পরিবহনে ট্রেনগুলোতে রেফ্রিজারেটেড কামরা সংযোগ এবং রেফ্রিজারেটেড ভ্যান ব্যবহারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
কৃষি ঋণ সহজীকরণঃ
কৃষকের অপর্যাপ্ত নিজস্ব মূলধন ও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা গ্রামীণ দরিদ্র্র কৃষকদের উৎপাদনকে ব্যাহত করে। আনুষ্ঠানিক অর্থায়ন প্রাপ্তিতে সুযোগের অভাবের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদেরকে অনানুষ্ঠানিক ঋণ উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়। কৃষিতে ঋণ নিয়ে কেউ খেলাপী হয়নি যেমনটি অন্যান্য ক্ষেত্রে হয়েছে। তাই এক্ষেত্রে কৃষকবান্ধব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ জরুরী ভিত্তিতে নেয়া প্রয়োজন।
কৃষি সম্প্রসারণঃ
যথাযথ সম্প্রসারণ সেবার মাধ্যমে প্রযুক্তির হস্তান্তর, বহুমুখীকরণ ও ফসল উৎপাদন কার্যক্রম নিবিড়তর করা যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। যথা সময়ে ও স্থানে প্রয়োজনীয় কারিগরি পরামর্শ এবং ব্যবস্থাপনা সহায়ক সম্প্রসারণ সেবা প্রদান করতে হবে। বর্তমানে গবেষণালব্ধ ফলাফলের পাশাপাশি কৃষকদের বিভিন্ন উদ্ভাবনার নতুনত্ত্ব থেকে সম্প্রসারণ সেবা শক্তি লাভ করে। অন্যদিকে এই সেবা গবেষণা থেকে সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করে ও কৃষকদের কাছে হস্তান্তর করে। আবার সম্ভাব্য সমাধানের জন্য কৃষকের বিভিন্ন সমস্যা গবেষকদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের জন্য গবেষণালব্ধ ফলাফল কৃষকের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। গবেষণা, সম্প্রসারণ সেবা ও কৃষকের কার্যকর সংযোগ জোরদার করা প্রয়োজন।
বর্ণিত বিষয়াদি ছাড়াও করোনা দূর্যোগত্তোর কালে কৃষি প্রবৃদ্ধি/উৎপাদন নিশ্চিতকরনে অগ্রসরমান কৃষি গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ/বাস্তায়ন, মানসম্পন্ন বীজের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি ও টেকসই সম্প্রসারণ সেবা পদ্ধতি উন্নয়ন আবশ্যক এবং কৃষিতে অর্জিত সফলতার ধারাবাহিকতা রক্ষাকল্পে অবিলম্বে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বয় সাধনপূর্বক কার্যকরী কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা সমীচীন।
লেখক:-সদস্য পরিচালক (পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল